বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ যাত্রা: ভুল সিদ্ধান্ত ও প্রতারণার ফাঁদ — বিশ্লেষণ, উদাহরণ ও সমাধান
বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ যাত্রা: ভুল সিদ্ধান্ত ও প্রতারণার ফাঁদ — বিশ্লেষণ, উদাহরণ ও সমাধান

বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই মানুষের এক বড় অংশ বিদেশে কাজ করার, ভালো আয়, উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি ভুলভাবে গড়া হয় — কম তথ্য, বিকৃত আশা, প্রতারণাপূর্ণ এজেন্সির ফাঁদে পড়ে — তাহলে তা শুধু ব্যক্তির নয়, পরিবারের এবং সম্প্রদায়ের জন্যও বিপজ্জনক হয়।
এই আর্টিকেলটিতে আলোচনা হবে:
1. কেনো মানুষ ভুলভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বিদেশ যেতে গেলে
2. কেনো তারা প্রতারণার সহজ শিকার হয়
3. বর্তমান কিছু পরিসংখ্যান ও উদাহরণ
4. সমস্যাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ
5. সমাধান ও নীতি-প্রস্তাবনা
6. ভবিষ্যতের পথ
কেনো বিদেশ যাত্রার সিদ্ধান্তে ভুল হয়?
আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক চাপ
· সমাজ ও পরিবারের প্রত্যাশা: অনেক ব্যক্তি দেখেন, কিছু আত্মীয় বা বন্ধু বিদেশে গেছেন, ভালো কাজ করেছেন, সহ–পরিবার উন্নতি হয়েছে। এমন দৃশ্য তাদের মনে বিদেশ যাওয়া যেন একমাত্র উপায় হিসেবে গড়ে তোলে।
· গর্ব ও সামাজিক মর্যাদা: “বিদেশি কাজ”, “বিদেশে পড়াশোনা”, “প্রবাসের টাকা পাঠানো” — এসব কথায় সমাজে মর্যাদাও যুক্ত হয়, তারা মনে করেন একজন সফল প্রবাসী হয়ে আসার মাধ্যমে পরিবারের সম্মান বাড়বে।
· দরিদ্রতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা: ঘরে পারিবারিক দায়, ঋণ, শিক্ষা খরচ, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ — এসব কারণে মানুষ ঝুঁকি নিয়েও বিদেশ যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন, যদিও সব তথ্য জানা নেই।

অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও তথ্যের ঘাটতি
· চুক্তি ও নিয়োগপত্র (contract): অনেকেই গ্রহণ করেন মৌখিক প্রতিশ্রুতি; লিখিত চুক্তি হয়তো থাকে না, বা শর্তগুলি স্পষ্ট নয় (বেতন, কাজের সময়, কাজের ধরণ, বাসস্থান, খরচ কর্তন ইত্যাদি)।
· ভিসা নিয়ম ও আইনগত বিষয়: যেসব দেশে যাবেন তাদের ভিসা নিয়ম, অভিবাসন আইন, শ্রম আইন সম্পর্কে তথ্য কম পাওয়া যায়। অনেক সময় এজেন্টরা জানে না, বা জানায় না।
· ভ্রমণ খরচ ও ঋণ: ভ্রমণের খরচ, এজেন্ট ফি, মেডিকেল পরীক্ষার খরচ, পথ খরচ — এসব অনেক সময় খেলাপি হয়। অনেক প্রার্থী পূর্ণ খরচ উঠাতে পারছেন না; পূর্বে ধার নেওয়া হয়, বিকল্পভাবে বাড়িতে-বাড়িতে টাকা বা স্বপ্নি ফি (advance fee) দেওয়া হয়।
মনস্তাত্ত্বিক ও চরিত্রগত কারণে
· বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষার অধিকতা: “বিদেশে গেলেই সব ঠিক হবে”, এই ভাবনা প্রচলিত।
· ভয় যখন ব্যর্থতা ও ফিরে আসার: কিছু মানুষ ভয় পান যদি সিদ্ধান্ত না নেন এবং পরে সুযোগ সংকুচিত হবে, তাই তাড়াহুড়ো করেন।
· সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিবার বা এজেন্টের dominion: অনেক ক্ষেত্রে এজেন্ট বা মধ্যস্বত্বভোগী (middlemen) পরিবারে প্রবল প্রভাব ফেলে, ব্যক্তির নিজের কথা কম শোনা যায়।
কেনো প্রতারণার শিকার হওয়া সহজ?

বৃহত্তর প্রতারণাপূর্ণ এজেন্ট ও দালালের জাল নেটওয়ার্ক
· অবৈধ বা রেজিস্ট্রেশনহীন এজেন্সি: BAIRA-র মত বৈধ সংস্থাগুলো থাকলেও অনেক এজেন্সি বা সাব-এজেন্ট রেজিস্টার হয় নি। যারা রেজিস্টার হয়েছেন তাও সবসময় নিয়মানুগ কাজ করেন না।
· উচ্চ ফি ও অগ্রিম টাকা: গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৫-এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ২৫টি নিয়োগ এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে যেসব এজেন্সি মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রার্থী শ্রমিকদের থেকে সরকার নির্ধারিত ফি-এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ফি নিয়েছে। (Business & Human Rights Resource Centre)
· Smart card / Exit-permit প্রতারণা: উদাহরণস্বরূপ, UAE-তে যাওয়া প্রাক্কালে BMET-এর রেকর্ড অনুযায়ী, ৬,৯৩৮টি Smart Card ইস্যু করা হয়েছিল, যেসব অধিকাংশই অনুমোদিত Employment Permit ছাড়া ইস্যু করা। (Dhaka Tribune)
আইনি ও প্রশাসনিক ফাঁক
· BMET, ACC, মন্ত্রণালয়গুলোর তদারকি ও নিষ্ক্রিয়তা: যদিও কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা হয়, কিন্তু অনেক অভিযোগ নিষ্পত্তি হতে আটকে থাকে। অভিযোগ দায়েরের সময় দেরি হয়, প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন হয়।
· নিয়মিত পরিদর্শন ও জরিমানা ব্যবস্থা দুর্বল: এজেন্সি লাইসেন্স বাতিল ও সাময়িক সাসপেনশন হয়, কিন্তু পুনরায় কাজ শুরু করা হয়, বা অন্য নামে কাজ করতে থাকে।
· লিগ্যাল সহায়তার অভাব: অনেক প্রার্থী জানে না কোথায় অভিযোগ করবেন, বা ব্যবহারের পদ্ধতি, বা তারা ভয় পান আর্থিক ও সামাজিক ঝুঁকি।
আর্থিক হানিকর পরিণতি
· অনেকেই বিদেশ যাওয়া খরচ সেই অনুযায়ী উঠাতে পারছেন না; ঋণ বাড়ে, স্বল্প খরচে কাজ করতে বাধ্য হয়, বেতন আবার দেরি হয় বা কর্তন করা হয়।
· কিছু ক্ষেত্রে “debt bondage” অর্থাৎঋণ-বাঁধা অবস্থায় পড়েন, যেখানে কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা খুব খারাপ হয়।
তথ্য জালিয়াতি ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব
· ভুয়া কাজের অফার: বেতন, কাজের ধরণ, বাসস্থানের সুবিধা সবই আদর্শভাবে বড় করে দেখানো হয় কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
· ভুয়া ডকুমেন্ট ও পরিচয়পত্র: জন্মনিবন্ধন, বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্রে তথ্য ভুল বা পরিবর্তন করা হয়; দালালদের মাধ্যমে ভুয়া স্মার্ট কার্ড/exit permit/visa document ব্যবহার করা হয়। (justice.gov)
· সাংবাদিক অনুসন্ধান ও NGO রিপোর্ট: এই বিষয়ে অনেক রিপোর্ট বলেছে যে তথ্য ও বিজ্ঞাপন অনেক সময় বিভ্রান্তিকর হয়, এবং ভুক্তভোগীরা সব জায়গায় যোগাযোগ করতে পারছেন না।
বর্তমান কিছু পরিসংখ্যান ও উদাহরণ
পরিসংখ্যান:
বিষয়
পরিমাণ / তথ্য
BMET-এ অভিযোগ
২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ১,১১২ জন প্রার্থী BMET-এ রিক্রুটিং এজেন্সি, মধ্যস্বত্বভোগী বা নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। (The Business Standard)
নিয়োগ এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা
২০২৫ সালে ACC ২৫টি নিয়োগ এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে যে তারা মালয়েশিয়া যাওয়া প্রার্থীদের থেকে সরকার নির্ধারিত ফি-এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ফি নিয়েছে। (Business & Human Rights Resource Centre)
Smart card fraud
BMET-এর Smart Card ব্যবহারে প্রতারণা; UAE-তে অনুমোদিত Employment Permit ছাড়া অনেক Smart Card ইস্যু করা হয়েছে; ৬,৯৩৮টি কার্ড ইস্যুর মধ্যে অনেকগুলি বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে নয়। (Dhaka Tribune)
আবেদনের ক্ষেত্রে নথিপত্র জালিয়াতি
দালালদের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন, বিদেশ যাওয়া সংশ্লিষ্ট ভোটার কার্ড বা অন্যান্য সনদে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, ডাকাতি বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে নথিপত্র ভুয়া বা ভুল তথ্যসহ হওয়া — অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। (ecoi.net)
শ্রমিক প্রত্যাবর্তন ও খালি হাত ফিরে আসা
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে অনেক শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে বেতন পাননি, কাজের ধরণ ভিন্ন ছিল, বাসস্থান খারাপ ছিল, অনিয়মিত অবস্থায় পড়ে গিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে অবৈধভাবে থাকার কারণে প্রবাদ‐দায়িত হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। (dailyindustrybd.com)
উদাহরণ:
· Saudi Arabia-র ঘটনা: সৌদি আরব গমন করার সময়ে একজন প্রার্থী হয়তো হোটেল কাজের কথা শুনেছিলেন, কিন্তু গিয়েই বুঝলেন কাজের শর্ত ও পরিবহন, বাসস্থান, বৈধ পরিচয়পত্র নন, বেতন পাননি। rubel hossain নামের একজন ফিরে এল মাত্র কিছু মালপত্র নিয়ে। (dailyindustrybd.com)
· Meranti Binamas মামলা, মালয়েশিয়ায়: ৩৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিক একটি নিয়োগকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে; তারা বলেছে যে কাজের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল — বেতন, কাজের ধরন — কিন্তু সেটি বাস্তব হয়নি এবং অতিরিক্ত ফি নেওয়া হয়েছিল, পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়েছিল। (Business & Human Rights Resource Centre)
· Smart card ব্যবহার করে প্রতারণা: যেমন BMET ও কিছু এজেন্সি সম্মিলিতভাবে Smart Card রেকর্ডে প্রতারণা করছে UAE গমন বিষয়ক। (Dhaka Tribune)
· বয়স, নারী ও কনসুলেট/এমিগ্রেশন অফিসে অনিয়ম: BMET অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও এজেন্সি মিলেমিশে কনসুলেট বা বিদেশ গমন-নির্ধারণে অনিয়ম করেছে; কাগজপত্র জাল করা হয়েছে, অভিবাসন আইন ভঙ্গ করা হয়েছে। (newagebd.net)
ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ও প্রতারণায় পড়ার যে কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে — গভীর বিশ্লেষণ

আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা
· দরিদ্রতা ও সীমিত বিকল্প: প্রথম থেকেই উপজেলাতেই বা গ্রামের মানুষের বিকল্প কম, শিক্ষাগত সুযোগ কম, কাজ কম। তাই বিদেশ যাওয়া একটি স্বপ্ন এবং বিকল্প মনে হয়।
· ঋণ ও ভবিষ্যতের দায়: বিদেশে গিয়ে আয় করে পরিবার ও ঋণ মেটানোর প্রত্যাশা থাকে। এই প্রত্যাশার কাছে অনেক বেশি ঝুঁকি থাকে, যা অপরিকল্পিত হলে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
প্রয়োগকারীর ক্ষমতার অভাব
· ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির অভাব: গন্তব্য দেশে ভাষা, নিয়ম, সংস্কৃতি ভিন্ন। যারা ইংরেজি বা গন্তব্য দেশীয় ভাষা জানে না, তাদের জন্য situational পরিবর্তন কঠিন হয়।
· দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ: বাসস্থান, খাদ্য, পরিবহন, স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদির মান নিশ্চিত না হলে সমস্যা হয়।
সরকারের কাঠামোগত ও নীতি-দৃষ্টিকোণ
· নিয়োগ এজেন্সির নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা: যদিও রয়েছে BMET, ACC ইত্যাদির তদারকি সংস্থা, কিন্তু তারা সব অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারছে না।
· আইনগত রূপায়ণ ও প্রযোজনা নিয়ে গণ্ডগোল: অনেক আইন রয়েছে কিন্তু বাস্তবে enforcement কম।
· তথ্য ও সেবার অবাধ্যতা: অনেক দূরবর্তী এলাকায় বা অভিভাবকদের আপডেট নেই, অভিযোগ ব্যবস্থা জানে না, যোগাযোগ ব্যর্থ হয়।

কি-কি সমস্যাগুলি দেখা যায় ও তাদের প্রভাব
· আর্থিক ক্ষতি ও ঋণ বোঝা: বিদেশ যাওয়া খরচ, এজেন্ট ফি, ও খরচ বেড়ে যায় এবং আয় কমিয়ে দেওয়া হয় বা বাদ দেওয়া হয় — যার ফলে ঋণ বেড়ে যায় ও পরিবারে আর্থিক চাপ বাড়ে।
· শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুরাবস্থা: নতুন পরিবেশ, কঠিন কাজ, ভালো বাসস্থান বা সুরক্ষা না পাওয়া, শ্রম-নির্যাতন — এসব কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট হয়।
· আইনি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন: অনেক বিদেশি শ্রমিক বৈধভাবে কাজ করেন না, কাজের শর্ত অনুযায়ী বেতন পান না, কাজের চুক্তি পালিত হয় না, পরিবার বা দূরে থেকে কোনো যোগাযোগ কাঠামো নেই।
· সামাজিক ও পারিবারিক প্রভাব: ব্যর্থ হলে সামাজিক মর্যাদা কমতে পারে, পরিবারে মানসিক চাপ বাড়ে, পড়াশোনা বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় বিরাম পড়ে।
সমাধান ও প্রস্তাবনা: কি করলে এই সমস্যা কমে আসবে?

নিচে বিস্তারিত সমাধান দেওয়া হলো, যা নীতি-স্তর থেকে শুরু করে স্থানীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ পর্যন্ত বিস্তৃত:
তথ্য ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ
· গ্রামীণ সচেতনতাগঠিত কর্মসূচি: স্কুল, কলেজ, মডেল হাই স্কুল, মাদ্রাসা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে “বিদেশ যাওয়া ও প্রতারণার ঝুঁকি” বিষয়ক ওয়ার্কশপ ও আলোচনা সভা আয়োজন করা।
· সফল ও ব্যর্থ অভিজ্ঞতার গল্প প্রচার: ফিরে আসা অভিবাসীদের গল্প প্রচার করা — কি ভালো হয়েছিল, কি খারাপ হয়েছে — যাতে ভুল ধারণা কমে।
· অনলাইন ও সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার: Facebook, YouTube, TikTok-এ ছোট ভিডিও, ইনফোগ্রাফিকস, সতর্কবাণী প্রচার করা; ভুয়া বিজ্ঞাপনগুলোর বিরুদ্ধে Fact-checking বাড়ানো।
এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ ও নীতি প্রয়োগ
· কঠোর লাইসেন্সিং ও রেজিস্ট্রেশন: সব নিয়োগ এজেন্সি ও সাব-এজেন্টদের আদর্শ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক; লাইসেন্স নবায়ন এবং নিয়মিত নিরীক্ষণ (audit) থাকতে হবে।
· সরকারি ফি ও নিয়োগ ফি নিয়ন্ত্রণ: সরকার নির্ধারিত ফি বেশি হলে সরকারকে অনুমোদন ও নজরদারি করা উচিত; অতিরিক্ত ফি নেওয়া হলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা।
· শ্রম আইন ও অভিবাসী আইনগুলোর উন্নয়ন: গন্তব্য দেশ ও বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি/মূল্যায়ন থাকতে হবে যেন শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
প্রারম্ভিক প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া ডিসিপ্লিন
· Pre-departure orientation: বিদেশ যাত্রার আগে কাজের চুক্তি, আইন, সংস্কৃতি, ভাষা, স্বাস্থ্য সেবা, যোগাযোগ মাধ্যম, দেশে সমস্যা হলে কোথায় যোগাযোগ করা যাবে ইত্যাদি বিষয়ে অপরিহার্য প্রশিক্ষণ।
· দক্ষতা উন্নয়ন ও ভাষা শিক্ষা: গন্তব্য দেশে কাজের ধরনের জন্য প্রয়োজনীয় technical ও soft skills উন্নয়ন; গন্তব্য ভাষার কিছুটা জানা থাকলে সমস্যার সম্ভাবনা কমে যাবে।
আর্থিক নিরাপত্তা ও সহায়তা ব্যবস্থা
· ঋণ উপযোগী ও স্বচ্ছভাবে দেওয়া: বিদেশ যাত্রার জন্য ঋণ নিতে হলে সুদের হার, অর্থ পরিশোধের সময়সীমা, ফি-খরচের সম্পূর্ণ ব্যপারে প্রার্থীকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া।
· Welfare ফান্ড ও বিমা: বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য বিমা বা ক্ষতিপূরণ কভিড-স্তরের বা দুর্ঘটনা-সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য; প্রস্থান ও প্রত্যাবর্তন ফান্ড শক্তিশালী করা।
অভিযোগ নিবারণ ও আইন প্রয়োগ
· Complaint resolution mechanism দ্রুত ও নিরপেক্ষ করা: BMET, ACC, শ্রম মন্ত্রণালয়, দূতাবাসগুলোর মধ্যে দ্রুত ও কার্যকর তদারকি থাকা; অভিযোগ দাখিল এবং সত্যায়ন প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা।
· প্রয়োজনে আইনি সহায়তার সুযোগ বাড়ানো: চাকরিপ্রার্থী বা অভিবাসীদের রাইটস / অভিযোগ করতে যেতে পারে এমন এনজিও বা আইনজীবী একটি নেটওয়ার্ক গঠন।
· সংশ্লিষ্টদের শাস্তিযোগ্যতা বাড়ানো: যারা প্রতারণা বা কাগজপত্র জালিয়াতিতে লিপ্ত তারা শাস্তি ভোগ করবে; শুধু এজেন্সি নয়, বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বা দালালদেরও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা করা হবে।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল উদ্ভাবন
· অনলাইন যাচাইকরণ পোর্টাল: এমন একটি পোর্টাল যেখানে প্রার্থী এজেন্ট, কাজের অফার, ভিসা টাইপ, কাজের দেশ, নিয়োগকারী সংস্থা সব কিছু যাচাই করতে পারবেন।
· বায়োমেট্রিক ও ডকুমেন্ট সিকিউরিটি বৃদ্ধি: জন্মনিবন্ধন, নাগরিক পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন ফাইল ইত্যাদিতে উন্নত সিকিউরিটি ফিচার — যেমন বায়োমেট্রিক সাইনেচার, QR কোড, ডিজিটাল যাচাইকরণ।
· মোবাইল অ্যাপ / SMS সার্ভিস: যেখানে অভিবাসীরা ট্র্যাক করতে পারবেন কাজের অবস্থা, flight/travel schedule, অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন, এবং দূতাবাসে যে কোনো জরুরি সাহায্য পেতে পারবেন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও চুক্তি

· ডেস্টিনেশন দেশে শ্রম রক্ষার চুক্তি (MOU): গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া উচিত যাতে বিদেশে কাজের পরিবেশ, মানুষের অধিকার, শ্রম আইন একই রকম রক্ষা করা হয়।
· তথ্য ও অভিবাসন নীতি সমন্বয়: দুই দেশের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়, অভিবাসীদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার তথ্য শেয়ার করা।
· আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলোর ভূমিকা: জাতিসংঘ, ILO, অন্যান্য শ্রম অধিকার সংস্থা মাধ্যমে মনিটরিং, সচেতনতা ও সহায়তা বাড়ানো।
সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ ও বর্তমান অগ্রগতি
· BMET ও ACC বিভিন্ন এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলাসমূহ দায়ের করেছে; Tk1,159 কোটি (বাংলাদেশি টাকা)-র অনিয়মের ব্যাপারে ১৩টি компанийের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে মালয়েশিয়া-গমন প্রার্থীদের অতিরিক্ত ফি নেওয়ার কারণে। (Dhaka Tribune)
· Smart Card সমস্যার তদন্ত হয়েছে; BMET ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু নিয়োগ এজেন্সিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। (Dhaka Tribune)
· BMET-এর শরিক হওয়া অভিযোগ নিষ্পত্তি করার তৎপরতা বাড়ছে: উদাহরণস্বরূপ, August ২০২৩-এ BMET ১৮৬টি অভিযোগ পায়, তার মধ্যে ৯৬টি নিষ্পত্তি করা হয়। (The Business Standard)
চ্যালেঞ্জ ও বাধা
· তথ্য সংগ্রহে এবং অভিযোগ দাখিলে প্রমাণের অভাব: অনেক সময় প্রার্থী কাছে প্রমাণ থাকে না — চুক্তিপত্র, রেজিস্টার নম্বর, নাম ঠিকানা প্রভৃতি। যেসব হয়, ওসব হারিয়ে যায় বা নকল হয়।
· শিক্ষাগত ও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা: অনেক প্রার্থী পড়াশোনা কম, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা কম; সাহিত্যিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্রস্তুত নয়।
· দূরত্ব ও যোগাযোগ: গ্রাম-গ্রাম, দরিদ্র এলাকার মানুষ অনেক সময় সরকারি অফিস বা BMET অফিসে যেতে পারে না, তথ্য পেতে পারে না, যোগাযোগ ব্যয় বেশি হয়।
· অনেক এজেন্সি চেঞ্জ নামে পুনরায় কাজ শুরু করে: যারা একটি নামে শাস্তি পেয়েছে তারা অন্য নামে কাজ শুরু করে; কাজের নাম, ঠিকানা পরিবর্তন হয়।
· স্বল্প প্রত্যাশা ও মানসিক প্রস্তুতির অভাব: প্রার্থী বিশ্বাস করেন যে সমস্যা হলে “ভালো না হলে ফিরে আসব” — কিন্তু ফিরতে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা নেই।
ভবিষ্যতের পথ: একটি সমন্বিত কৌশল
নিচে একটি ধারাবাহিক কাজের রোডম্যাপ দেওয়া হলো, যা সরকারের, বেসরকারি এজেন্সি, এনজিও, সমাজ ও নাগরিক মিলিয়ে কাজ করলে বিদেশ যাওয়া অভিজ্ঞতা বিপজ্জনক থেকে সুফলবহু হতে পারে:
1. তথ্য কেন্দ্র ও হেল্পডেস্ক গঠন
প্রত্যেক জেলা/উপজেলায় একটি “বিদেশি কর্মস্থল হেল্পডেস্ক” হবে যেখানে তথ্য দেওয়া হবে, অভিযোগ নেওয়া হবে, মামলা-প্রক্রিয়া সহজ হবে।
2. প্রত্যেক প্রার্থীকে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও যাচাইকরণ বাধ্যতামূলক
কাজের অফার, নিয়োগকারী এজেন্সি, ভিসা টাইপ, কাজের ধরন — all online system-এ রেকর্ড থাকবে। সামাজিক মিডিয়া ও এজেন্সির বিজ্ঞাপন এই সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
3. অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এজেন্সির রেটিং ও রিভিউ সিস্টেম
প্রার্থীরা অভিজ্ঞ প্রবাসী কিংবা যারা ফিরে এসেছেন তাদের অভিজ্ঞতা লিখে দিতে পাবেন, তা একটি পাবলিক রেটিং পোর্টালে প্রকাশিত হবে। এজেন্সি যারা রিভিউ খারাপ পাবেন, তাদের লাইসেন্স নবায়ন কঠিন হবে।
4. সরকারি সাহায্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিস্তার
বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের জন্য “উপযুক্ত রিনবোর্সমেন্ট পলিসি” থাকতে পারে যদি কাজ পাওয়া না যায়; শ্রমিক বিমা সুপরিমিত হোক; পর্যাপ্ত সহযোগিতা অফিস ও দূতাবাস থাকুক।
5. আইন প্রয়োগ ও বিচার দাঁড় করানো
প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; সরকারি কর্মকর্তাদেরও যদি যুক্ত থাকে, তাদেরও দণ্ড নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্র-সহ আন্তর্জাতিকভাবে যারা প্রতারণার নেটওয়ার্কে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়ানো।
6. বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
শ্রমিক সংগঠন, এনজিও, মিডিয়া, প্রবাসে অভিজ্ঞদের গ্রুপ — all মিলিয়ে কাজ করা উচিত। এনজিও-র মাধ্যমে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
7. নিয়মিত মনিটরিং ও মূল্যায়ন
প্রতি বছর বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ব্যাকফিডব্যাক সংগ্রহ করা হবে; কখনও কখনও স্থল-অভিজ্ঞতামূলক জরিপ করা হবে; যে নীতিমালা নিয়েছে তার ফলাফল পর্যালোচনা হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ যেতে চাওয়া একটি স্বাভাবিক ও মানবিক আকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে যারা আর্থিক নিষ্কৃতি, পরিবারের উন্নতি, নিজের স্বপ্ন পূরণের আশা রাখেন। তবে সেই যাত্রাটি যদি বিশ্বাস, তথ্য ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে না হয়, তাহলে স্বপ্নটা হতে পারে ভয়াবহ বাস্তবতার বিপরীত চিত্র।
ভুল সিদ্ধান্ত, প্রতারণার সহজ শিকার হওয়া — এসব কেবল ব্যক্তিরই নয়, সমাজের, দেশের উদ্ভাবনক্ষমতার বন্ধুরূপে কাজ করে। তবে যদি নীতি, আইন, সচেতনতা, প্রক্রিয়া সবগুলোই সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে বিদেশ যাওয়া শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন নয়, গঠনমূলক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
আমরা, সমাজ, ব্যক্তি, সরকার, এজেন্সি সবাই মিলিয়ে কাজ করলে, দেশের বাহিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হবে সাবধান, তথ্যবহুল ও স্বপ্নপূরণকারী — প্রতারণার শিকার হবে কম, উন্নতির পথ হবে বেশি উন্মুক্ত।
তথ্যসূত্র / রেফারেন্স
1. Rising number of migrant workers falling prey to fraudulence — The Business Standard / TBS News (The Business Standard)
2. Cases filed against 25 recruitment agencies for charging migrant workers bound for Malaysia fees 5 times the government-fixed rate — Business & Human Rights (Business & Human Rights Resource Centre)
3. ACC to sue 31 officials of recruiting agencies over … Tk1,159 crore irregularities — Dhaka Tribune / The Business Standard (Dhaka Tribune)
4. Smart card fraud in BMET / UAE exit permit issue — Dhaka Tribune (Dhaka Tribune)
5. Deceived overseas fortune seekers face hurdle to get remedies — The Business Standard (The Business Standard)
6. Malaysia lawsuit: Meranti Binamas case — Business & Human Rights / NGO reports (Business & Human Rights Resource Centre)
7. Reports of fraudulent documents, passports, birth certificates, etc. — Immigration/Refugee Board of Canada / Justice Department documents (justice.gov)
Comments
Post a Comment